সৎ কর্মকর্তাদের নিয়তি : কবীরকে তিরস্কার বঞ্চিত সারোয়ার জাদুঘরে মুনীর

‘ভালো, সৎ অফিসার। এই যোগ্যতায় এখন টিকে থাকতে পারবেন না। অনেক কিছু মিলিয়ে চলতে হবে। না হয় বঞ্চিত হবেন। হ্যাঁ, সৎ থাকবেন, ভালো কাজ করবেন; সঙ্গে ভালো পজিশনে টিকে থাকবেন? এর জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসারের উচ্চ পর্যায়ের বড় ধরনের আশীর্বাদ থাকতে হবে। তাহলে সহজে কেউ ঘাঁটাবে না। সবাই জেনে যাবে, তাঁর জোর আছে। যাঁর বড় কেউ নেই, তিনি ভালো থাকতে পারবেন না। যদি থাকতে চান, তাহলে ছিটকে পড়ে যেতে হবে।’ শনিবার (১৩ মার্চ) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন বাহরাম খান।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, সচিবালয়ে আলাপকালে একজন উপসচিব এভাবেই ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রশাসন ক্যাডারের আলোচিত কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন সম্প্রতি ‘তিরস্কার’-এর শাস্তি পেয়েছেন। অন্যদিকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে থাকা আরেক আলোচিত অফিসার সারোয়ার আলম সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি পাননি। প্রশাসন ক্যাডারের ২৭ ব্যাচের এই কর্মকর্তা বিভিন্ন আলোচিত ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছেন। সম্প্রতি তাঁদের দুজন ভিন্নভাবে ‘শাস্তি’প্রাপ্ত হয়েছেন। এ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে আলোচিত আরেক কর্মকর্তা মুনীর চৌধুরীকে দুদক থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে একটি জাদুঘরের দায়িত্বে।

এই সময় প্রশাসনের সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে মাহবুব কবীর মিলনের নাম সবাই জানেন। নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বে থাকার সময় রেস্টুরেন্টে মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে অনেক ভালো ভালো উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অধিদপ্তরে একটি স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অন্য সবার প্রশংসায় ভাসলেও যাঁদের নির্দেশ অনুযায়ী তদবির রাখেননি, তাঁদের বিরাগভাজন হয়েছেন। সে কারণে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। দুর্দশাগ্রস্ত এই মন্ত্রণালয় হাজার কোটি টাকা খরচ করেও সেবার মান ও ব্র্যান্ডিংয়ে যা করতে পারেনি, মাহবুব কবীর মিলন যোগ দিয়ে তার চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন। টিকিটিং সিস্টেম আধুনিকীকরণের মাধ্যমে দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধের উদ্যোগ নেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে সমস্যা সমাধানে কাজ করছিলেন। বেশির ভাগ সিনিয়র অফিসার যেখানে গণমাধ্যম এড়িয়ে চলেন, সেখানে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। অনিয়ম-দুর্নীতিসংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নে কথা বলেছেন। সেই সব কথাই তাঁর জন্য কাল হয়েছে।
গণমাধ্যমে কথা বলার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু করা হয়। লঘু দণ্ড হিসেবে ‘তিরস্কার’ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে মাহবুব কবীর মিলন কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সচিবালয়ে নিম্নস্তর থেকে উচ্চ পর্যায়ের অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেছেন। চাকরিতে থাকায় তাঁদের কেউই নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করেননি। একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, দেশের অন্যান্য সেক্টর যেভাবে চলছে সরকারি চাকরিতেও তা-ই হচ্ছে। এই সমাজের মানুষেরাই তো সরকারি চাকরিতে ঢোকে। মানুষ আশা করে, পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকে অফিসাররা প্রশিক্ষণ নেন, সরকারি টাকায় অনেক সুযোগ-সুবিধা পান, তাই তাঁরা ঠিকভাবে আইন-কানুন পরিচালনা করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। মাহবুব কবীর মিলনের মতো অফিসারকে এই শাস্তি দেওয়া তো শুধু তাঁকেই শাস্তি দেওয়া নয়, অন্য সবার প্রতি বার্তা দেওয়া হয়েছে—ভালো কাজ করা যাবে না। পূর্বসূরি ঔপনিবেশিকরা যা করে গেছে, তা-ই করো।

উল্লেখ্য, গত ১ মার্চ মাহবুব কবীর মিলনকে তিরস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে গত সপ্তাহে প্রশাসন ক্যাডারের ২৭ ব্যাচের দুই শতাধিক কর্মকর্তাসহ মোট ৩৩৭ জনকে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। সেই তালিকায় ২৭ ব্যাচের আলোচিত অফিসার সারোয়ার আলমের নাম নেই। বিষয়টি নিয়ে তাঁর ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সবাই নিরুত্তর থাকেন। একজন যুগ্ম সচিব বলেন, এসব অফিসারকে এভাবে থামিয়ে দিলে প্রশাসনে কেউ কাজ করতে সাহস পাবে না।

মন্তব্য জানতে চাইলে সারোয়ার আলম গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমার পদোন্নতি কেন হয়নি, তা আমার জানা নেই।’

শুধু তিরস্কার বা পদোন্নতিবঞ্চিতই নয়, ভালো অফিসাররা ভালো পদে পদায়নও পান না। পেলেও টিকতে পারেন না। সিনিয়র অফিসারদের অন্যায় তদবির না শুনলে ভালো পদে থাকা যায় না। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অন্যতম আলোচিত অফিসার মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী দুদকের মহাপরিচালক এবং এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের প্রধান ছিলেন। তিনি আইন-বিধি অনুযায়ী সততার সঙ্গে কাজ করেন। কারো অন্যায় নির্দেশ, তদবিরে কান দেন না। এই দোষে তাঁকে গত বিএনপি সরকারের আমলেও বিভিন্ন হয়রানি ভোগ করতে হয়েছে। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় তাঁর মতো একজনকে ডাম্পিং করা হয়েছে বলে প্রশাসন ক্যাডারের ভালো অফিসাদের মন্তব্য। মুনীর চৌধুরীকে দুদক থেকে সরানোর আদেশের প্রতিবাদে দুদকে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টারস অ্যাগেইনস্ট করাপশনের (র‌্যাক) পক্ষ থেকে নিন্দাও জানানো হয়েছিল। তাদের প্রতিবাদে বলা হয়েছিল, ‘এর মাধ্যমে দুদকের সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here